গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রয়ী মাসীক কাল : ডায়েট ও জরুরী টিপস ।। Second trimester of Pregnancy: Diet and tips

গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রয়ী মাসীক কাল : ডায়েট ও জরুরী টিপস  ।। Second trimester of Pregnancy:Diet and tips

second trimester in pregnancy
Designed by onlyyouqj / Freepik

গর্ভাবস্থার ১৩ সপ্তাহ থেকে ২৭ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কাল কে বলা হয় দ্বিতীয় ত্রয়ী মাসিক কাল(Second trimester)। গর্ভাবস্থার এই দ্বিতীয় ত্রয়ী মাসিক কাল প্রেগন্যান্সির সবচেয়ে ভালো সময়।শরীরে আরও কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন আসতে থাকে।শরীর ওজন বৃদ্ধি করতে শুরু করে, মানসিক আবেগ কিছুটা হলেও কম হয়। ধীরে ধীরে বমি ভাব ও গা গোলানো বন্ধ হতে থাকে। তবে অনেক মায়ের ক্ষেত্রে এই বমি ভাব আর কিছুদিন থাকে।এতদিনে মিসক্যারেজের সম্ভাবনা কমে গেছে, ভ্রূণ প্রতিস্থাপিত হয়েছে।প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালের মতই এখন আপনাকে সঠিক ডায়েট মেনে খেতে হবে।প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিনD, ফোলেট সমৃদ্ধ খাওয়ার খেতে হবে।

এই প্রতিবেদনটি তে আমরা আলোচনা করব দ্বিতীয় ত্রয়ী মাসিক কালে কি খাবেন আর কি খাবেন না(Diet chart in second trimester of pregnancy) এবং তার সাথে কিছু জরুরি টিপস। 

কি কি খাবেন (Foods to eat during second trimester of pregnancy) 

প্রোটিন যুক্ত খাওয়ার খান (Eat protein enriched food in your second trimester of pregnancy  )

প্রোটিন এই সময় ভ্রূণের শরীর ও মস্থিস্কের কলা গঠন করতে সাহায্য করে। এছাড়া ভ্রূণের শরীরে অ্যান্টিবডি, হরমোন, এনজাইম তৈরিতেও প্রোটিন সহায়তা করে। প্রোটিন মায়ের ইউটেরাস ও ব্রেস্টের কলা গঠনে সাহায্য করে। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ১০০ গ্রাম মত প্রোটিন গ্রহণ করা উচিৎ। ডাল, মাছ, মাংস, দুধ, দই, পনীর ইত্যাদি প্রোটিনের ভালো উৎস।

ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাওয়ার যোগ করুন (Take sufficient amount of carbohydrate in pregnancy)

কার্বোহাইড্রেট গর্ভাবস্থায় মা ও শিশুকে প্রয়োজনীয় শক্তি প্রদান করে। কার্বোহাইড্রেট হল আসলে শ্বেতসার বা জটিল শর্করা যা শরীরে ভেঙ্গে গিয়ে সরল শর্করা যেমন গ্লুকোজে পরিণত হয়। এই গ্লুকোজ অমরা বা প্লাসেন্তা অতিক্রম করে ভ্রূণে প্রবেশ করে ও ভ্রূণের বৃদ্ধির জন্য শক্তির জোগান দেয়।একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ১৭৫ গ্রাম থেকে ২১০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট প্রয়োজন যা আপনি ভাত, রুটি, রাঙ্গাআলু, ভুট্টা, যেকোনো ফল ও ফলের রস(দ্বিতীয় ত্রয়ী মাসিকের জন্য ফল ) ইত্যাদি থেকে সহজেই পেয়ে যাবেন। 

দাঁতের ডাক্তার কে দেখান ও ক্যালসিয়ামের সাপ্লিমেন্ট নিন(Talk to your doctor and take calcium supplement) 

প্রেগন্যান্সিতে ক্যালসিয়াম ও আয়রন এই দুটি খনিজের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশী। ক্যালসিয়াম ভ্রূণের দাঁত ও হাড় গঠন করে, মায়ের অস্টিওপোরোসিস রোগ প্রতিরোধ করে, দাঁতের ক্ষয় রোধ করে।একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ১২০০ গ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।এই সময় আপনার শরীর থেকে শিশু প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম নিচ্ছে, তাই দাঁতের ডাক্তার দেখান যে দাঁতে কোন ক্ষয় হচ্ছে কিনা। শুধুমাত্র খাদ্য উৎস থেকে এই সময় শরীরের ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট নিন।যেকোনো দুগ্ধ জাতীয় খাবার, কাঁটাযুক্ত মাছ, মাংস,সয়াবিন, আমন্দ,তিল ইত্যাদি ক্যালসিয়ামের খাদ্য উৎস।

আয়রনের সাপ্লিমেন্ট নিন ও শরীরে আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করুন(Take iron supplement and check your iron level in your second trimester of pregnancy ) 

আয়রন মায়ের শরীরে অক্সিজেন ধারন ক্ষমতা বাড়ায়, ভ্রূণের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করে, সময়ের আগে শিশুর জন্মানোর সম্ভাবনা কমায়।বীট, কলা, খেজুর, পালং শাক, ছোলা, আমন্দ, ডিম, মাংস ইত্যাদি আয়রনের খাদ্য উৎস। প্রেগন্যান্সি তে শুধু মাত্র খাদ্য উৎস থেকে আয়রনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।তাই আয়রন যুক্ত খাওয়ারের সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রনের সাপ্লিমেন্টও  গ্রহন করবেন। 

ভিটামিন D এর জন্য সাপ্লিমেন্ত নিন ও শরীরে রোদ্দুর লাগান(Get Supplement and soaked up in Sun for good amount of Vitamin D )

ভিটামিন D শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ ক্ষমতা বাড়িয়ে শিশুর দাঁত ও হাড়ের গঠনে সাহায্য করে।এই ভিটামিনের খাদ্য উৎস খুবই কম। চর্বিযুক্ত মাছ, বাঁধাকপি, ডিম, চীজ, মাশরুম ইত্যাদি ভিটামিন এর খাদ্য উৎস।তবে প্রেগন্যান্সিতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন D এর সাপ্লিমেন্ত গ্রহন করাই ভালো এবং তার সাথে প্রতিদিন সাতসকালে ৫ থেকে ১০ মিনিটের জন্য শরীরে রোদ্দুর লাগান।

ওমেগা3 ফ্যাটি অ্যাসিড ও ফোলেট যুক্ত খওয়ার খান এবং সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করুন(Omega 3 fatty acid and folic acid is must in your whole pregnancy )

ওমেগা3 ফ্যাটি অ্যাসিড দ্বারা মা ও সন্তান দুজনেই উপকৃত হয়। এই প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড ভ্রূণের মস্তিষ্ক, চোখ, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু তন্ত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।সময়ের আগে প্রসবের সম্ভাবনা কমায়।মায়ের উচ্চ রক্ত চাপ জনিত রোগ প্রিক্ল্যাম্পসিয়া রোধ করে এবং প্রসবের পরবর্তী সময়ে হওয়া মায়ের ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে।একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন ৬৫০mg ওমেগা-3ফ্যাটি অ্যাসিড প্রয়োজন।খাদ্য উৎস হল মাছ, চিয়া বীজ, আখরোট, অ্যাভোকাডো।

ফলিক অ্যাসিড গর্ভাবস্থায় কতটা জরুরী আমরা জানি।ফলিক অ্যাসিড শিশুর জন্মগত ত্রুটি রোধ করে, সময়ের আগে জন্মানোর সম্ভাবনা কমায়, গর্ভের মধ্যে শিশুর ওজন বাড়াতে সাহায্য করে,শিশুর কাটা ঠোঁট ও কাটা তালুর মত জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ করতে পারে, ভ্রূণের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।ফলিক অ্যাসিড মায়ের হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, এমনকি কিছু ক্যান্সারও প্রতিরোধ করে।গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ৬০০mcg ফলিক অ্যাসিড প্রয়োজন।কমলালেবু, ডিম, ব্রকোলি, বীট, লেবু, দুধ,পেস্তা বাদাম,আমন্দ ইত্যাদি ফলিক অ্যাসিডের খাদ্য উৎস। 

এবার দেখবো কি কি খাবেন না (Foods to avoid during second trimester of pregnancy)

মাছ কম পরিমানে খান। যে কোন মাছে থাকা পারদ ভ্রূণের মস্তিষ্কের ক্ষতি করে, বৃদ্ধি ব্যাহত করে।সামুদ্রিক মাছে পারদের পরিমান খুব বেশী থাকে তাই সামুদ্রিক মাছ কম খাবেন। মিষ্টি জলের মাছে পারদের পরিমান কম থাকে তাই এই ধরনের মাছ আপনি খেতে পারেন। আর মাছ সমসময় ভালো করে সেদ্ধ করে খাবেন।

কফি, চা, ডার্ক চকলেট, কফি যুক্ত এনার্জি বার, এনার্জি ড্রিঙ্কস ইত্যাদি তে ক্যাফাইন প্রচুর থাকে।এমন কি গ্রিন টি, কোলা, সোডা জাতিয় ড্রিংকসেও ক্যাফাইন থাকে।তাই এই সব খাবার এড়িয়ে চলুন।অতিরিক্ত ক্যফাইন ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে এমন কি মিসক্যারেজও ঘটাতে পারে। 

যে কোন কাঁচা প্রোটিন খাবেন না। এই সময় যে কোন প্রোটিন তা সে ডিম হোক বা মাংস ভালো করে সেদ্ধ করে খাবেন।এই সব প্রোটিনের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া যেমন সালমনেল্লা, কলিফর্ম ইত্যাদি থাকতে পারে যা ভ্রূণের ক্ষতি ও মিসক্যারেজ ঘটাতে পারে। 

যে কোন দুগ্ধ জাতিয় খাবার পাস্তুরাইজ না করা থাকলে খাবেন না। দুধ ভালো করে ফুটিয়ে খাবেন। কাঁচা দুধ খাবেন না।

অঙ্কুরিত যে কোন বীজ যেমন ছোলা,মুগ একদমই খাবেন না। ভেজানো কাঁচা ছোলা মুগ খাওয়া ভাল,কিন্তু যদি তা অঙ্কুরিত হয়ে যায় তাহলে তাতে সালমনেল্লা, লিস্টেরিয়া জাতিয় ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিতে পারে যা শিশুর জন্য খুবই ভয়ংকর।এই সব ব্যাকটেরিয়া আপনাকে ও আপনার শিশুকে অসুস্থ করে ফেলতে পারে, মিসক্যারেজও ঘটাতে পারে।

গর্ভাবস্থায় বেগুন কম পরিমানে খাবেন।এর মধ্যে প্রচুর পরিমানে ফাইটোহরমোন থাকে যা মাসিক চক্রিকাকে উদ্দীপিত করতে পারে।যার ফলে গর্ভপাত হতে পারে।এই সব্জি টি আবার ভিটামিন C ভিটামিন K,আয়রন,ফাইবার ইত্যাদি তে ভরপুর।তাই বেগুন একদম খাওয়া বন্ধ করার দরকার নেই,কিন্তু পরিমানে কম খাবেন।

আনারস কম পরিমানে খাবেন। আনারসে ব্রোমেলিন থাকে যা জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে পারে, জরায়ু নরম করতে পারে, যার ফলে মিসক্যারেজ বা সময়ের আগে শিশুর জন্ম হতে পারে।এছাড়া আনারসে থাকা টক বদহজম ও অ্যাসিড ঘটাতে পারে।কিন্তু আনারস আবার লহিত রক্ত কনিকা তৈরি করতে সাহায্য করে,হার্ট ও নার্ভ ভালো রাখে, ইমিউনিটি বৃদ্ধি করে। তাই আনারস খেলেও খুব কম পরিমানে খাবেন আর না হলে আপনার ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করুন কতটা পরিমান খাবেন।  

কিছু টিপস(Some Tips for your Second Trimester of Pregnancy)

সবসময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন। প্রতিদিনের মেনু তে প্রচুর পরিমানে শাক সব্জি ও ফল যোগ করুন। কোন কাঁচা শাক বা সব্জি খাবেন না। সবসময় ভালো করে রান্না করে খাবেন। ফল ভালো করে গরম জলে ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে খান।

সঠিক পরিমানে জল পান করুন। সারাদিনে ৪ লিটার জল অবসসাই খাবেন। জল অ্যামনইটিক তরলের পরিমান সঠিক রাখে, প্রেগন্যান্সিতে হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য , অর্শ্ব  রোগ প্রতিরোধ করে।  

একদমই অ্যালকোহল খাবেন না। এর খারাপ প্রভাব সবাই জানি। অ্যালকোহল গর্ভের মধ্যে শিশুর বিভিন্ন রোগ ঘটাতে পারে, এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে।

ধূমপান বর্জন করুন। ধূমপান কারি দের থেকেও দূরে থাকুন।

ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে কি কি টেস্ট করতে হবে তা জেনে নিন।দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক কালে দ্বিতীয় আলট্রাসাউন্ড করা হয় যার দ্বারা শিশুর বৃদ্ধি কেমন হচ্ছে,উচ্চতা কতটা, কোন জন্মগত ত্রুটি আছে কিনা দেখা হয়। মায়ের গ্লুকোজ টেস্ট করা হয়। ট্রিপল মার্কার টেস্ট বা কোয়াড্রাপল মার্কার টেস্ট করা হয়। 

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক কালে টিটেনাসের প্রথম টীকা দেওয়া হয়, সাধারণত ২০ সপ্তাহের পর। আপনার ডাক্তার নিশ্চয়ই আপনাকে দিয়ে থাকবে, নাহলে ডাক্তারকে জানান।

কখনই দুজনের খাবার খাবেন না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিক কালে প্রতিদিন আপনার অতিরিক্ত ৩০০ ক্যালোরি প্রয়োজন। নিজের ওজনের দিকে খেয়াল রাখুন। বেশী ওজন বাড়লে মায়ের উচ্চ রক্ত চাপ, স্বাভাবিকের চেয়ে বড় শিশু, সিজার দ্বারা প্রসব ইত্যাদি অসুবিধা দেখা দিতে পারে।তাছাড়া বেশী ওজন বাড়লে প্রেগন্যান্সির পর ওজন কমাতেও কষ্ট বেশী হবে।

কতটা ওজন বাড়লে সঠিক হয় তা আপনার ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করুন। তবে বলা হয় একজন স্বাভাবিক ওজন ও স্বাভাবিক BMI(১৮.৫ থেকে ২৪.৯) যুক্ত মহিলার প্রথম ত্রৈ মাসিক কালে ১ থেকে ২ কিলো ওজন বাড়ে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিক কাল প্রতি ২ সপ্তাহে গড়ে ১ Kg মত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ, অর্থাৎ পুরো প্রেগন্যান্সিতে ১৪ কিলো মত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ। আপনি যদি আন্ডার ওয়েট বা ওভার ওয়েট হন তাহলে এর পরিমান কিছুটা বেশী বা কম হবে। আর যদি আপনার যমজ সন্তান হওয়ার কথা থাকে তাহলে সম্পূর্ণ প্রেগন্যান্সিতে ১৫ থেকে ২০ কিলো ওজন বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ। 

মাতৃত্বের দ্বিতীয় ধাপ উপভোগ করুন, খুশি থাকুন। 

এই প্রতিবেদনটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে এক্ষুনি অন্য মায়েদের সাথে শেয়ার করুন। 

  

 

    

  

   

    

Recommended Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.