গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালঃ কি করবেন ও কি করবেন না || First Trimester of pregnancy: what to do what not in Bengali.

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালঃ কি করবেন ও কি করবেন না ।। First Trimester of pregnancy: what to do what not in Bengali.

First trimester diet in bengali

এত মাস ধরে গর্ভধারণ করার চেষ্টা এত দিনে সফল হয়েছে।অভিনন্দন আপনাকে আপনি গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে(ফ্রাস্ট ট্রাইমেস্টার) পদার্পণ করেছেন। কথায় বলে যে একজন সুস্থ মা, সুস্থ সন্তানের জন্ম দেয়। তাই এখন থেকে আপনাকে নিজের ও আর আপনার ভেতর বেড়ে চলা ছোট্ট মানুষটির বিশেষ যত্ন নিতে হবে। সঠিক ডায়েট ও লাইফ স্টাইল আপনার প্রেগন্যান্সির সময় কাল কে আরও সুন্দর করে তোলে। তবে এখন থেকে ২ জনের জন্য খাওয়ার প্রয়োজন নেই শুধু কিছুটা অতিরিক্ত ক্যালোরি আপনাকে গ্রহণ করতে হবে(Pregnancy food chart in bangla)।

স্বাস্থ্যকর গর্ভাবস্থা ডায়েট পরিকল্পনা কেমন হবে তা নিয়েই আমাদের এই প্রতিবেদন। প্রথমে আসি খাদ্যাভ্যাস নিয়ে।  খাদ্য তালিকায়, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ওমেগা 3ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার থাকতে হবে। এই সব নিউট্রিশান আপনার প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে ভ্রূণের বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন জন্মগত ত্রূটি যেমন স্পাইনা বিফিডা (Spaina bifida এক  ধরনের  জন্মগত ত্রূটি যার ফলে মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্ক সঠিক ভাবে গঠন হয়না) ।

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে কী খাবেন(What to eat in your first trimester of pregnancy)

ফলিক অ্যাসিড(Include folic acid enriched food and supplement in your first trimester diet)

ফলিক অ্যাসিড বা ফোলেট এক ধরনের B-ভিটামিন যা গর্ভধারণের প্রথম ১৩ স্পতাহে (ফ্রাস্ট ট্রাইমেস্টার) সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পূর্ণ। ভ্রূনের বেশীর ভাগ জন্মগত ত্রূটি এই প্রথম কয়েক সপ্তাহেই তৈরি হয়। সঠিক মাত্রায় নেওয়া ফলিক অ্যাসিড এই জন্মগত ত্রূটি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৭০% কমিয়ে দেয়। ফলিক অ্যাসিড  শরীরকে কোষ তৈরির প্রধান উপাদান প্রোটিনকে কাজে লাগাতে সাহায্য করে।এছাড়া DNA ও লহিত রক্ত কনিকা গঠনেও সাহায্য করে তাই এই সময় প্রতিদিন আপনার অন্তত ৬০০mcg ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করা উচিৎ। তবে কতটা ডোজ আপনার জন্য সঠিক হবে তা আপনার ডাক্তার কে অবশ্যই জিজ্ঞেস করে নেবেন।(Pregnancy food chart in bengali)

উৎস-আখরোট, পেস্তা বাদাম, ডিম, ছোলা, মুগ, ব্রকলি, সূর্যমুখী বীজ, চিয়া সিড, শতমূলী, কমলা লেবু ইত্যাদি।

আয়রন(Iron is an important nutrient in first trimester of pregnancy)

আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতি খুবই দেখা যায়। মায়ের শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে শিশুর শরীরে অক্সিজেন কম পৌঁছবে যার ফল সরূপ ভ্রূণের গঠন ও বৃদ্ধি বিঘ্নিত হবে।আয়রনের ঘাটতি সময়ের আগে শিশুর জন্মানোর(Premature birth)সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। শরীরে আয়রন কম থাকলে মায়ের ক্লান্তি ভাব বেশী হবে। যদিও এই সময় ক্লান্তি ভাব খুবই স্বাভাবিক কিন্তু সেই ক্লান্তি যদি আয়রনের ঘাটতির ফলে হয় তাহলে তা মা ও শিশু দুজনের ওপরি কুপ্রভাব ফেলবে। তাই যদি অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ করেন তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে শরীরে আয়রনের মাত্রা পরীক্ষা করুন।ভিটামিন C শরীরে আয়রন শোষণ বৃদ্ধি করে।তাই আয়রন যুক্ত খাওারের সাথে ভিটামিন C যুক্ত খাওয়ার যেমন কমলালেবু, বেল পেপার, বেরি, আঙ্গুর, আপেল ইত্যাদি খেতে হবে।

উৎস-পালং শাক,ডিম, মুরগির মাংস, ছলা,খেজুর, কলা ইত্যাদি(মনে রাখবেন প্রাণীজ উৎসের তুলনায় উদ্ভিজ উৎস থেকে পাওয়া আয়রন গ্রহণ করা বেশী ভালো।)

ক্যালসিয়াম(Calcium enriched food is must in your pregnancy diet )

ক্যালসিয়াম শিশুর হাড় ও দাঁত গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়।মায়ের শরীরে কালসিয়ামের ঘাটতি হলে শরীর মায়ের হাড় থেকে ক্যালসিয়াম নিয়ে বর্ধিত ভ্রূণে সরবরাহ করবে। ফলসরূপ মায়ের শরীরে ক্যালসিয়ামের অতিরিক্ত ঘাটতি জনিত রোগ যেমন ভঙ্গুর হাড় বা অস্টিওপোরোসিস  রোগ দেখা দেবে। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন প্রায় ১২০০ মিলি. গ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন।ক্যালসিয়ামের শোষণের জন্য ভিটামিন D এর প্রয়োজন তাই প্রতিদিন সকালে অন্তত ৫ মিনিটের জন্য শরীরে রোদ লাগান ও সাপ্লিমেন্ট  গ্রহণ করুন।

উৎস- দুধ, দই, পনীর, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ঢ্যাঁড়স, কাঁটাযুক্ত মাছ, আমন্ড  ইত্যাদি

ওমেগা 3 ফ্যাটি অ্যাসিড-( Omega-3 fatty acid is necessary in your pregnancy diet)

শিশুর বুদ্ধির এবং স্নায়ু তন্ত্রের সঠিক বিকাশের জন্য ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড গ্রহণ করলে শিশুর শৈশবে চোখের দৃষ্টিশক্তি, বুদ্ধি, ও ভাষার বিকাশ খুব ভালো ভাবে হয়। তিন ধরনের ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিডের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ হল EPA ও DHA।একজন মায়ের প্রতিদিন প্রায় ২০০mg ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড প্রয়োজন। খাদ্য উৎসের তুলনায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা ভালো।  

উৎস- আখরোট, চিয়া বীজ, ফ্ল্যাক্স সিড, ডিম, মাছ ইত্যাদি।

জিঙ্ক(zinc is a necessary trace element in your first-trimester diet  )

জিঙ্ক শরীরের কোষের গঠনের জন্য জরুরি। একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন শুধুমাত্র ১১mg জিঙ্কের প্রয়োজন। ডাক্তার যে সব ভিটামিন ও সাল্পিমেন্ট আপনাকে দিয়েছেন তার মধেই এই প্রয়োজনীয় পরিমান জিঙ্ক থাকে। তবে যদি আপনার মনে কোন শঙ্কা থাকে তাহলে ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করুন।

উৎস- ডাল, ছোলা, ডিম, আমন্ড , কাজু, চিনে বাদাম, দুধ ইত্যাদি

এছাড়া এই প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে ভিটামিন A ,D, C যুক্ত খাওয়ার খেতে হবে।এই সময় মায়ের প্রায় ৭০ থেকে ১০০ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন হয়। তাই প্রোটিন যুক্ত খাওয়ার ডিম, মাংস, মাছ, ডাল ইত্যাদি খান।কোষ্ঠ কাঠিন্য এই সময় খুবই কমন ব্যাপার। উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাওয়ার যেমন বাদামি ভাত, ওটস, ছোলা, মুগ, সবুজ মটর, ভুট্টা, ব্রকলি ইত্যাদি খান।

এতক্ষন দেখলাম যে কি কি খেতে হবে এবার দেখব কি কি খাওয়া বন্ধ করতে হবে

গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে কী খাবেন না (What to  avoid during your first trimester of pregnancy)

গৰ্ভাৱস্থায় ভালো ডায়েট মেনা চলা খুবই জরুরি।কি খাবেন সেটা জানার সাথে কি কি খাবেন না সেটাও জানা জরুরি।

অ্যালকোহল(Must avoid alcohol before and during pregnancy)

গর্ভবতী হওয়ার আগে থেকে শুরু করে পুর প্রেগন্যান্সিতে কখনই মদ্য পান করা উচিৎ নয়। অ্যালকোহল পান করলে তা আম্বিলিক্যাল কর্ড দিয়ে অমরা বা প্লাসেন্টা তে প্রবেশ করে ও ভ্রূণের বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়, ও বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক রোগের সৃষ্টি করে।

ক্যাফাইন( Limit your caffeine intake during pregnancy )

বিভিন্ন রিসার্চে দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ক্যাফাইন যুক্ত খাওয়ার যেমন চা, কফি, এনার্জি ড্রিঙ্কস ,ডার্ক চকলেট ইতাদি মিসক্যারেজের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তাই এই সব খাওয়ার কম খাওয়াই ভালো। প্রতিদিন ২০০mg এর বেশী ক্যাফাইন গ্রহণ করা উচিৎ নয়, তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি একদমই না খান।

মাছ(Avoid high Mercury fish during first trimester of pregnancy)

ভাবছেন যে বাঙালি হয়ে মাছ খাব না। না না ঠিক তা নয়।যে কোন মাছে থাকে পারদ যা ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশে কুপ্রভাব ফেলে। সামুদ্রিক মাছে পারদের পরিমান অনেক বেশী থাকে। তাই সামুদ্রিক মাছের পরিবর্তে মিষ্টি জলের মাছ খেতে পারেন।

আধ সেদ্ধ ডিম ও মাংস(Uncooked or under cooked protein can be dangerous during first trimester )

ডিম ও মাংসে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া, লিস্টেরিয়া, ইত্যাদি থাকতে পারে যা গর্ভাবস্থার প্রাথমিক দিকে গর্ভপাত বা মিসক্যারেজ করাতে পারে।তাই প্রাণীজ প্রোটিন সর্বদা ভালো ভাবে রান্না করে খাবেন।ডিমের পোচ, হাফ বয়েল ডিম বা আধসেদ্ধ মাছ, মাংস একদমই খাবেন না।

কিছু টিপস(Some tips about what to do and what not during first trimester of pregnancy)

দুজনের খাওয়ার খাবেন না(Don’t eat for two)। গর্ভবতী হলেই সবাই আপনাকে বলবে যে এবার বেশী করে খেতে হবে দু জনের জন্য খেতে হবে। কিন্তু এই ধারনা একদম ভুল। আপনাকে সঠিক পুষ্টিগুন যুক্ত খাবার খেতে হবে। প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে আপনার শুধু এক্সট্রা ১০০ ক্যালোরি প্রয়োজন হবে। অতিরিক্ত খেলে শুধু শুধু ওজন বৃদ্ধিই হবে যা সুস্থ প্রেগন্যান্সির জন্য মোটেই কাম্য নয়।

নিজের ওজনের দিকে খেয়াল রাখুন(Watch your rate of weight gain)। কম ওজন বা বেশী ওজন কোনটাই গর্ভাবস্থার জন্য ভালো না। প্রথম ৩ মাসে একজন মায়ের ১ কেজি থেকে ১.৫ কেজি ওজন বৃদ্ধি হয়।

কখনই কোন মিল স্কিপ করবেন না(Don’t skip your meal)। এই সময় সকালে গা বমি ভাব, গা গোলানো, অলসতা, ক্লান্তি খুবই স্বাভাবিক। অনেক মা মনে করেন যে তিনি যদি না খান তাহলে হয়ত এই লক্ষন গুলো কমে যাবে। এটা খুবই ভুল ধারনা। খাওয়ার না খেলে বমি ভাব, গা গোলান আরও বাড়বে। বমি ভাব ও গা গোলানো ভাব কমাতে আদা ও তুলসি পাতা দিয়ে ফোটানো জল খান, ডাবের জল, বা সাধারন লেবু, বিট নুন দিয়ে একটু ঠাণ্ডা জল খান। প্রত্যেক ৩ ঘণ্টা অন্তর খাওয়ার খান। খালি পেটে একদমই থাকবেন না। আর যদি খুবই বমি হয় তো ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

অতিরিক্ত পরিশ্রুত মিষ্টি বা রিফাইন্ড সুগার খাবেন না(Limit your sugar intake)। গর্ভাবস্থায় সুগার বা ডায়াবেটিস অনেক মায়েদের দেখা যায় যাকে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলে। অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়ার, চিনি, আইসক্রিম, কুকিজ, পেস্ট্রি, বিস্কুট, চকলেট ইত্যাদি শরীরে ইনসুলিনের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে ও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। মায়ের ডায়াবেটিস সন্তানের সময়ের আগে জন্ম, জন্মের পর সন্তানের লো সুগার ইত্যাদির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। মিষ্টি হয়ত একদম বন্ধ করা সম্ভব নয় কিন্তু সন্তানের ভালোর জন্য এর পরিমান আপনি কমাতেই পারেন।

শরীরে জলের ঘাটতি বা ডিহাইড্র্যাশন না হয় সেদিকে নজর রাখুন(Keep your system hydrated)। জল প্রেগন্যান্সির সময় হওয়া কোষ্ঠ কাঠিন্য ও অর্শরোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। জল প্রেগন্যান্সির সময় হওয়া ইউরিন ইনফেক্সান বা মূত্র নালির সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। সারাদিন কমপক্ষে ৪ লিটার জল খান।

ধুমপান করবেন না(Don’t Smoke)।এর ক্ষতিকর প্রভাব আমরা সবাই জানি।তাই নিজেও করবেন না ও ধুমপানকারি দের থেকেও দূরে থাকুন।

ভ্রূণের প্রতিস্থাপন হয় ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে, তাই এই প্রথম ত্রয়ী মাসিক কালে বেশী শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করবেন না। তার চেয়ে বরং প্রানায়াম ও খুবই হাল্কা যোগাসন করতে পারেন।সবসময় শরীর বুঝে কাজ করুন।

মাতৃত্বের প্রথম ধাপ উপভোগ করুন ও হাসি খুসি থাকুন।

এই প্রতিবেদন টি যদি ভালো লেগে থাকে তাহলে এক্ষুনি অন্য মায়েদের সাথে শেয়ার করুন। 

  

 

 

 

Recommended Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.